Sunday 10 April 2022

পরিবার আর স্কুল শিক্ষার ফল-- রূপো বর্মন

পরিবার আর স্কুল শিক্ষার ফল 
রূপো বর্মন 

একদিন সকাল দশটা নাগাদ। বছর এগারোর একটি মেয়ে ও একটি ছেলে বেশ আনন্দে হাটতে হাটতে স্কুলে যাচ্ছে। দুজনের গায়ে নীল আর সাদা রঙের জামা পায়ে সাদা মজা এবং কালো বুট জুতো। পিঠে ঝোলানো সাদা রঙের ব্যাগ দুটি যেন শান্তির ঝোলা। চোখ ফেরানো যায় না নিষ্পাপ মনের নিষ্পাপ হাসি দেখে।



হঠাৎ একটা কথা শুনতে পেলাম "ইস, লোকটাকে মেরে ফেলল বুঝি"। কথাটি অবশ্য আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বাস গাড়ির জন্য অপেক্ষারত ব্যক্তি বলেছিলেন। কথাটি শোনামাত্র আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। তারপর দেখতে পেলাম সাত আট জনের মতো মানুষ একটি চলন্ত গাড়ির পেছন পেছন ছুটছে। গাড়িটিতে ওঠার জন্য। তাদের গায়ে ধাক্কা লেগে একজন মানুষ মাটিতে পড়ে গেছে আর সবাই ওই মানুষটির উপর ভর দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম  মাটিতে পড়ে থাকা মানুষটি নিজের জামা কাপড় ঝেড়ে উঠছে আর থলে থেকে পড়ে যাওয়া জিনিস গুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে থলেতে ঢোকাচ্ছে। তার মধ্যে কিছু কিছু জিনিস আমার চোখে পড়ল সেগুলো ছিলো প্লাস্টিকের বোতল, ছেড়া খবরের কাগজ, নষ্ট হয়ে যাওয়া আপেল, পঁচা কলা, ভাঙ্গা বিস্কুট আর পাউরুটির কয়েকটা টুকরো। আমি তো অবাক হয়ে গেছিলাম লোকটিকে এসব ব্যাগে ঢোকাতে দেখে। তারপরেই খেয়াল করলাম লোকটির জামা কাপড় গুলো খুব নোংরা এবং ছেড়া। রোগা পাতলা চেহারায় একমুখ দাড়ি, মাথায় বড়ো বড়ো চুল। কয়েকজন লোক বলে উঠল "পাগল বলে মানুষ আজকাল মানুষকে মানুষ বলে মনে করে  না, কি দিন এলো"। কথাটি শোনামাত্র আমার কাছে এটা পরিস্কার হয়ে গেল যে, এতক্ষণ ধরে যাকে আমি দেখছি সে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ যাকে আমরা সহজ ভাষায় পাগল বলে থাকি।




পাগলটির ওই জিনিস গুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে থলেতে ঢোকানোর সময় স্কুলের পথে রওনা দেওয়া বাচ্চা দুটি সেখানে এসে হাজির হলো। পাগলটির থলের সব অপরিস্কার জিনিস বের করে দিল এবং তাদের দুজনের স্কুলের টিফিনের খাবার গুলো পাগলটিকে দিয়ে দিল। আর অনেকের জুতোর আঘাতে পাগলটির বাম হাতে একটু চামড়া উঠে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। তখন তারা তাদের রুমাল দুটি দিয়ে পাগলটির হাত বেঁধে দিল। তারপর দুজনে পাগলটির হাত ধরে আমার থেকে হাত দু-এক দূরে এনে বসাল। অবশ্য আমি একটি বিশ্রামাগারে দাঁড়িয়ে ছিলাম গাড়িতে ওঠার জন্য। তারপর তারা পাগলটিকে বলল "কাকু রাস্তা পার হওয়ার সময় ডান দিক বাম দিক দেখে পার হবেন। নোংরা খাবার খাবেন না, চুল দাড়ি নখ কাটবেন এবং প্রতিদিন স্নান করবেন, আর সবসময় জামা কাপড় পরিস্কার রাখবেন"। এই কথা গুলো বলে দুজনে পাগলটির পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল "কাকু আজ আমাদের পরীক্ষা আছে আমাদের আশীর্বাদ করুন যাতে আমরা ভালো করে পড়াশোনা করতে পারি আর মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি"। বাচ্চা দুটির কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রাস্তায় একটি রিকশাওলা বাচ্চা দুটি কে ডাকল এবং বাচ্চা দুটিও রিকশায় উঠে পড়ল। যখন রিকশাটি স্কুলের পথে রওনা দিল। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে ভাবতে লাগলাম, এটাই হয়তো পরিবার শিক্ষা আর স্কুল শিক্ষার ফল।

Saturday 9 April 2022

অকৃত্রিম অভিলাষকলমে- তাপসী ব্যানার্জী

অকৃত্রিম অভিলাষ
কলমে- তাপসী ব্যানার্জী

ছক্কা .....  আ.... 
আরে, এ তো ধীমান দার গলা মনে হচ্ছে ।
শ্রীমতী ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলে ফেলল কথাটা রুমা কে
অবশেষে রুমাদের বাড়ি পৌঁছালো তারা।
রুমা টি.ভি. টা একটু চালাবি।
রাস্তায় আসার সময়ে একটি দোকানের টি.ভি. তে  আই.পি.এল  কমেন্ট্রিতে যার গলা পেলাম আমার ভীষণ পরিচিত মনে হল।
টি.ভি.  টাতে পিকচার আসা মাত্র লাফিয়ে উঠল শ্রীমতী
ধীমান দাই তো!!!...
রুমা কৌতুহলবিষ্ট হয়ে জিজ্ঞাসা করল, বিশেষ পরিচিত??
হ্যাঁ রে, আমি যখন স্কুল,  ধীমানদা তখন কলেজে কিন্তু আমাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া একই ছিল। 
কোনদিন ভাবিনি ওই পাড়া থেকে চলে এসে অন্য কোথাও থাকতে হবে 
হারিয়ে ফেলে ছিলাম আমার সমস্ত স্বপ্ন। 
আজ ও কে এত দিন পরে টি.ভি. তে দেখার পর নতুন করে স্বপ্ন জেগে উঠল মনে,  ইচ্ছা করছে পুরোনো পাড়ায় গিয়ে একবার দেখা করি ওর সঙ্গে।।

Thursday 7 April 2022

ঘর--সন্ধ্যা রায়

ঘর--

সন্ধ্যা রায়

অচিন্ত্য দত্তের বাড়ি খিদিরপুর । অচিনত দত্তর মেয়ের নাম ববিতা, তার ডাকনাম বুবু। ছেলের নাম রণন, তাকে রাণি বলে সবাই ডাকে l স্ত্রীর নাম তৃষা। দত্তবাবু অনেক রাতে পার্টি করে

রাতে বাড়ি ফিরে এলে উনার স্ত্রীর সঙ্গে আর কোন কথা হয় না। তাই  সকাল বেলা স্ত্রী শুধালো, কালকে রাতে কোন পার্টি ছিল এত রাত্রে বাড়ি ফিরলে?কৈ আমায় বলনি তো?

দত্ত বাবু একটু রাগ চটা মানুষ বটে। এমনিতে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ঝগড়া লেগেই থাকে। আর দুচার কথার পরেই তিনি চিৎকার দিয়ে ওঠেন।

সকালে স্ত্রীর কথা শুনেই দত্তবাবুর মাথায় আগুন লেগে গেল, তিনি চিৎকার করলেন, বেরিয়ে যাও বেরিয়ে যাও ঘর থেকে,  তোমার থেকে অনুমতি নিতে হবে আমার? মোটা একটা বসতার  মতন দেখতে, কোন পোশাকে তোমাকে মানায় না, অসহ্য লাগে। আমার সাথে তোমাকে নিয়ে যেতে হবে ? সহ্য করতে পারিনা তোমাকে, বেরিয়ে যাও। তোমাকে নিয়ে পার্টিতে যেতে পারবো না। 

শুনে মেয়ে বলল, মানিয়ে নিতে পারো না বাবার সাথে তখন কেন সকালবেলা লেগেছ মা ! 

ছেলে বললো, বাবা মনে করে তুমি একটা আনকালচারড,  তারপরও তুমি কেন মেনে নিতে পারো না। তুমি কেন বুঝতে চাও না মা? 

দত্ত বাবু ছেলে মেয়েকে নিজের মত করে ভালো শিখিয়ে রেখেছ। 

তৃষ্ণা সকলের সুখ স্বাচ্ছন্দ দেখতে দেখতে কবে  নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে নিজেও জানে না। তৃষাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল অচিন্ত্য। তৃষ্ণা এম এ  ইন ইংলিশ ছিল। তৃষা  একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরিও করতো। সে আজ সহ্য করতে পারলো না, ছেলে মেয়ের কথাগুলি, স্বামীর এই বঞ্চনা । সে ঘর ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে ঠিক করে নিল। সাথে সাথে তৈরি হয়ে সে একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল । কারো সাথে কোনো কথা বলল না, কেউ তাকে জিজ্ঞাসাও করল না।

ও নিজেকে বলল, আস্তানা ঠিক পেয়ে যাব, আমি যাচ্ছি। এই বলে বেরিয়ে গেল তৃষ্ণা। 

একটু পরেই ববিতা বলল, আমার ড্রেস প্রেস করা নেই । টিফিন বক্স তৈরি নেই, আমি কি করে স্কুলে যাব, বাবা? 

অচিন্ত্য বাবু বললো, কাজের মেয়েটা ব্রেকফাস্ট করে দেবে, তৈরি হয়ে যাবে, স্কুলে চলে যাবে-- এরপর তিনি নিজে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলেন অফিসের উদ্দেশ্যে। কাজের মেয়েটা এলে চিন্তায় পরল। এমনটা কোনদিন হয় না ম্যাডামই তো সব বানিয়ে দেয়। সে যা পারল করে দিলো, তারপরে রণন আর ববিতা বেরিয়ে গেল স্কুলে। 

বিকেলে অচিন্ত্য ঘরে এসে দেখে দোরগোড়ায় কতগুলি জুতো কাল থেকে পড়ে আছে। কেউ সরায়নি, ব্যালকনিতে অনেক জামাকাপড় কাচা আগোছালো এখানে ওখানে পড়ে আছে। কেউ তোলার নেই।  রনি আর বুবু স্কুল থেকে ফিরেছে। অচিন্ত্য বলল, বুবু তুমি এসব জামা কাপড় গুলো গুছিয়ে ফেল-- 

বুবু পরিষ্কার বলল, ওসব মার কাজ, মা করবে , আমি করি না। 

অচিন্ত্য বাবু এবার রনিকে বলল, রনি তুমি জুতোগুলো গুছিয়ে তুলে রাখ তো সেলফে। 

রনিও বলল, আমি পারবো না বাবা, এটা মায়ের কাজ, মাই করে, মাকে বলো। মাকে তুমি   তাড়িয়েছে বাবা, এখন কাজ তো তোমাকেই করতে হবে। এখন রাতের খাবার কে বানাবে বল ? সেটাও তোমাকেই করতে হবে। তুমি মাকে কেন তাড়ালে বাবা ?

অচিন্ত্য বলল, আজ রাতে আমাদের হোটেলের খাবার খেতে হবে। সে সকালে উঠেই চিন্তায়  পড়ল । কাজ মানে  এতো কাজের সমুদ্র। ঠিক করলো আজ আর অফিসে যাবে না। ভাবলো তৃষা কত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে । সময় মতন খাওয়া-দাওয়া, সবকিছু সময় মত, যেন একটা অফিসারের  ঘর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শান্তির নীড়। আমি শুধুই গঞ্জনা বঞ্চনা করি ওকে, বুঝতেই চাই না।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই কেন যে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলাম। সোজা সাপটা জবাবটা দিলেই ত মিটে যেত। এত মাইনে পাই একটা ভালো কাজের লোক রাখলেও নিজের খেয়াল রাখতে পারত। ভুলটা আমার। নাঃ ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। এটা আমার উচিত হয়নি।

 

অচিন্ত্য আজ অফিস যাইনি বলে ওর অফিস কলিগ কাজল আর ওর হাসবেন্ড বেড়াতে আসলো। এসেই প্রথম প্রশ্ন কিরে, আজ অফিস যাসনি কেন? 

অচিন্ত্য বলল, তৃষ্ণার মার শরীর খারাপ তাই ও ও বাড়ি গেছে । আমি ছেলে মেয়ে সামলাচ্ছি আর অফিস যাওয়া হল না। কাজল বলে উঠল, দিদিভাই নেই, তবে আজকে আর বিরিয়ানি খাওয়া হলো না। ওরা কিছুক্ষণ বসে ঘরে ফিরে গেল। 

সকাল হতেই অচিন্ত্য বন্ধু, রঞ্জনের ফোন এলো। রঞ্জন বলল, কিরে আজ সকালবেলা মন্দিরে গিয়েছিলাম । দেখলাম, ওখানে বৌদি লাইনে দাঁড়িয়ে ভোগ খাচ্ছে। কি হল বল তো এতদিন এরকম তো কোনদিন দেখিনি? 

অচিন্ত্য বলল, আমি ফোন রাখছি পরে তোকে সব বলবো।

এই বলেই সে ফোন রেখে দিল। আর তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে কার নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি পৌঁছাল কালীমন্দিরে, দেখল তৃষা ওখানে ভোগ খাচ্ছে, কালীমন্দিরের চত্বরে বসে। অচিন্ত্য তৃষার কাছে গিয়ে ওর হাতটা ধরে সোজা চলে এসে কারের মধ্যে বসিয়ে দিল তৃষাকে। বিনা বাক্য ব্যয়ে অচিন্ত্য ঘরে পৌঁছে গেল। তৃষাকে জড়িয়ে ধরে বলল-আমার ভুলের সাজা আমার বাচ্চাদের দিও না । আমি ভুল করেছি, এ ভুল আর কখনো হবে না তৃষা। বাচ্চারা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বাচ্চাদের কাঁদতে দেখে তৃষ্ণা বলল, এ ঘর আমার এ ঘর ছেড়ে আমি কখনো যেতে চাইনি। আমি আর কখনো তোমাদের ছেড়ে যাবো না।

যে যেখানে দাঁড়িয়ে --তাপসকিরণ রায়

যে যেখানে দাঁড়িয়ে --
তাপসকিরণ রায়

রমাকান্ত দেখেছেন মানুষের আর্থিক অবস্থা মানুষকে একটা স্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়। যেমনটা তোমার সমর্থ তেমন ছাঁচে তোমায় চলতে হয়। তোমার চারপাশটাও তেমনি ভাবে গড়ে ওঠে। 
রমাকান্তদের আর্থিক অবস্থা একদিন তেমন একটা ভাল ছিল না।  
সেদিন রমাকান্ত রেশনের দীর্ঘ লাইনের শেষ দিকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার সময় গুনে যাচ্ছিলেন। মেয়ে-বৌদের তখন আলাদা লাইন। এক সময় মিষ্টি এক কণ্ঠ রমাকান্তর কানে এসে পৌঁছল, রমা দা, তুমিও আমাদের মত লাইনে দাঁড়িয়ে ? 
চোখ তুলে তাকিয়ে ছিলেন রমাকান্ত, অনন্যা লাইনে দাঁড়িয়ে।   
অনন্যা আবার বলে উঠেছিল, তুমি কেন ? রুমা কৈ ?
রমাকান্তর বোন রুমাই বরাবর রেশনের লাইনে দাঁড়ায়। অনন্যা ওর সঙ্গে এক স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। সেই সূত্রে অনন্যার ওদের ঘরে যাতায়াত ছিল। রমাকান্ত ছোট বেলায় যে একেবারে লাইনে দাঁড়াননি তা নয়। কিন্তু কিছুটা বড় হওয়ার পর আর তিনি লাইনে দাঁড়াবার মানসিকতা খুঁজে পেতেন না। মার বারবার বলা সত্ত্বেও তিনি রেশন নিতে যেতেন না। এ জন্যে বাবার কাছ থেকে তাঁকে কড়া কথা শুনতে হত, লাইনে দাঁড়াতে লজ্জা করে ? আমাদের মত গরীবদের এমনি লজ্জা করলে চলে ? বাবা আরও একটু রেগে গেলে বলতেন, তুমি কোথাকার লাটের বাট হয়ে গেছ ?
কথা সত্যি। উঠতি বয়সের রমাকান্ত তখন কিছুটা উড়ু উড়ু মন নিয়ে ঘুরে বেড়ান। ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট ছাড়া তাঁর পরতে ইচ্ছে হয় না--সেদিন অনন্যাকে তিনি বলে ছিলেন, রুমার শরীর খারাপ। 
--ও, ছোট জবাব ছিল অনন্যার।
রেশনের দুটো লাইন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছিল। এক সময় পেছনে দাঁড়ানো অনন্যা রমাকান্তর কাছ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে ছিল। এগোতে এগোতে রমাকান্তর হাত, কাঁধ এসে ঠেকছিল অনন্যার শরীরে। অনন্যা স্বাভাবিক, কিন্তু রমাকান্তর কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল। এ অনন্যার দিকে তিনি কখনো আগে ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখেননি। মনে হল যেন এই প্রথম তাঁর চোখ পড়ল। শ্যামলা রঙের মাঝে শ্রীময়ী আঁকের এক চেহারা, খুব সহজ সরল লাবণ্যময় এক চেহারা বলে মনে হল। ভিড়ের ঠাসাঠাসি অবস্থায় ওর মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। মাথার এলোমেলো কেশ বিন্যাসের ফাঁকে ফাঁকে তার চারপাশের ছোট ছোট চুলগুলি শৈল্পিক ধাঁচে ফিনফিন উড়ছিল। অনন্যার চোখ রমাকান্তের চোখে এসে পড়ল। রমাকান্ত তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নিলেন। 
--রমা দা, আপনি একটু ঘুরে আসুন না বাইরে থেকে ? খুব ঘামছেন আপনি। 
তাকালেন রমাকান্ত অনন্যার দিকে। শান্ত এক মুখচ্ছবি, কথায় তার সহানুভূতির সুর। কিন্তু তার বেশী কিছু নয়, চেহারা স্বাভাবিক, মুখের হাসি সীমিত, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে না। এমনি একটা মেয়ে যে আছে তাঁদের গরীব ঘরের সীমান্তে তিনি যেন ভাবতেই পারেননি। কৈ আগে তো রমাকান্তর চোখে কোন দিন এমনি ভাবে পড়ে নি ! অথচ এক পাড়ায় বাস তাদের। হ্যাঁ, তাদের মত গরীব জরাজীর্ণ ধাঁচের ঘরের দিকে, সে সঙ্গে রিক্ত অর্থহীনতায় ভোগা পরিবারের দিকে কোন দিন তেমন ভাবে রমাকান্তর নজর পড়েনি হবে। 
--রমা দা, আমি আপনার লাইনটা দেখব, আপনি যান না, বাইরের হাওয়ায় একটু ঘুরে আসুন, মেয়েটি আবার বলে উঠলো। অনন্যার শান্ত মুখে রমাকান্ত আবার সহানুভূতির ছাপ দেখতে পেলেন। ভাল লাগছিল তাঁর, এমনি একটা মেয়েকে আলাদা ভাবে কে না পছন্দ করতে চাইবে ? ওদের পরিবারের দৈন্য অবস্থার মধ্যে মেয়েটিকে যেন মানায় না। ওদের ঘর,  জীবনযাত্রার মাঝে কেমন করে এই মেয়েটি হারিয়ে যেতে পারে ?
--না--ঠিক আছি আমি, রমাকান্ত সেদিন বলেছিলেন। আসলে ভালো লাগছিল—বীতশ্রদ্ধ লাইনে দাঁড়িয়েও তাঁর যেন সেদিন খুব ভালো লাগছিল। এই একটি ঘণ্টায় তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছিল ! অনন্যার মনের সঙ্গ পাবার জন্যে তাঁর মন যেন লালায়িত হয়ে উঠছিল। তিনি বলেছিলেন না, আমার কিছু অসুবিধা হচ্ছে না। 
রেশন তোলার সময় ব্যাগ ধরে সাহায্য করেছিল অনন্যা। ও সেদিন অন্য এক একক চেহারা নিয়ে রমাকান্তর সামনে ধরা দিয়েছিল।
তারপর দেখা হত অনন্যার সঙ্গে, কথা হত। অনন্যা স্বাভাবিক আর রমাকান্ত ছিল কিছুটা উচ্ছল। এমনি করে ওরা ধীরে ধীরে একে অন্যের কাছে এগিয়ে এসেছিল। এবং একটা সময় এসেছিল যখন উভয়ের সান্নিধ্য-ভালবাসা প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিল। 
সময় তার ধর্মে এগিয়ে চলছিল। ইতিমধ্যে রমাকান্ত পাস করে চাকরি পেয়ে দূর দেশে বেরিয়ে গেল। চাকরির পাঁচটা বছরও কেটে গেল। তিনি বাবা মাকে নতুন ফ্যাটে নিয়ে তুললেন। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বড় মাইনেতে রমাকান্ত তখন ধনবান। দৈন্য অবস্থার লক্ষণগুলি তাঁদের চেহারা পোশাক থেকে ক্রমশ: সরে গিয়েছিল।
অনন্যার সঙ্গে গোনা কয়েক বার দেখা হয়েছে রমাকান্তর। কিন্তু আগের সেই চোখ যেন তিনি হারিয়ে ফেলে ছিলেন। অনন্যা তাঁর চোখে অনেকটা মলিন মনে হয়েছিল। দুঃখ দারিদ্র্যতার জরাজীর্ণ ছাপ যেন অনন্যাকে ঘিরে ধরছিল।  
সত্যি কি তাই--সত্যি কি অনন্যা তার  রূপ গুণ সৌন্দর্য স্বভাব হারিয়ে ফেল ছিল ? রমাকান্ত বুঝতে পারছিলেন না। অনন্যাও চেহারা ছবিতে তার প্রেমিক রমাকান্তকে চিনে উঠতে পার ছিল না। 
--তোমরা তো চলে যাচ্ছ, আমার কি হবে রমা দা ? অনেক কষ্টে অনন্যা বলতে পেরেছিল কথাগুলি। 
--তুমি তো আমার থাকবেই অনন্যা, আমি আসব, তোমায় দেখে যাব, রমাকান্তর তাঁর আওয়াজে তখনও বুঝি সেই আপনত্ব হারিয়ে ফেলতে পারেননি! 
একদিন সময় আড়াল করে নিলো সব। রমাকান্ত অনন্যাকে ভুলতে বসলো।  অনন্যা এক সাধারণ মেয়ে, বস্তির সমতুল্য এক বাসিন্দা বই তো নয় ! তার বেশবাস বড় নগণ্য, অনুজ্জ্বল বলে মনে হত রমাকান্তর। এখনকার রমাকান্ত যে বড় বর্ণময়--চাকচিক্যের মাঝে চকমকি পাথরের মত উজ্জ্বল !   তাঁর কি করে মনে হবে অনন্যা তাঁর জীবন সঙ্গিনী হতে পারে ? ওর বুভুক্ষু পরিবারকে তিনি কি নিজের সঙ্গে  মানিয়ে নিতে পারবেন ? না, তা আর সম্ভব নয়--শত বর্ণাঢ্যের মাঝে  প্রসাধনী রঙচঙ মোহ  তখন তাঁর যে  পছন্দ ! সভ্যতার রঙরাংতার মোড়া দেহই যেন তাঁর একান্ত কাম্য। ধনীর মেয়েদের মাঝে তিনি কিছুতেই অনন্যাকে মানিয়ে নিতে পারেন  না। আর তাই বুঝি একদিন তিনি সব কিছু ভুলে গিয়ে এক ধনবান বাবার আধুনিকা মেয়েকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করেছিলেন। 
বিয়ের পরের দশটা বছরও কেটে গেল। রমাকান্ত তখন তাপনিয়ন্ত্রিত ঘর, গাড়ী ছাড়া চলতে পারেন না। একটুতেই তিনি হাঁপিয়ে যান, তাঁর ফর্সা মুখে লাল ছোপ পড়ে যায়। আজকাল অনন্যা তাঁর স্মৃতিতে মাঝে মধ্যে এসে উদয় হয়। নিজের স্ত্রীর দায়বদ্ধতা বড় বেশী হয়ে তাঁর চোখে ধরা পড়ে। স্ত্রীর ব্যবহার কাঠিন্য সময়ে অসময়ে তাঁকে বেশ পীড়া দিয়ে যায়। এসবের মাঝে তাঁর হঠাৎ হঠাৎ অনন্যার কথা মনে পড়ে যায়। একবার মনে হত তিনি যদি অনন্যাকে বিয়ে করতেন তা হলে বোধহয় এমনটা হত না। কিন্তু না--ওই অর্থহীন দীনতা, ওই পরিশ্রমের ঘাম চিপচিপ অবস্থা তিনি কি বরদাস্ত করতে পারতেন ? রমাকান্ত দেখেছেন, সংসারের জব্বর দায়- গ্রস্ততা, অর্থের স্বচ্ছন্দ সীমার মাঝেও শান্তির দীনতা, মনের অমিল বোঝার টানাপোড়েন। সব মিলিয়ে মনের মাঝে কোথাও যেন শূন্যস্থান থেকেই যায় ! কামিনী কাঞ্চন দপ জ্বলে উঠে তার আলো হারিয়ে ফেলে। এক অদ্ভুত সুখ দুঃখের দহনে পুড়ে যেতে থাকে মনের গভীরতা। তাই বুঝি এক মেঘলা দিনে রমাকান্ত একলাটি বেড়িয়ে পড়েছিলেন কোন অজানায় পাড়ি দিতে ! 
সেদিন রমাকান্ত নিজের অজান্তেই কি এসে পড়েছিলেন তাঁদের সেই গরীব হতশ্রী গ্রামে ? তিনি সামনে দেখতে পেলেন তাঁদের জরাজীর্ণ সেই পুরানো ঘরটাকে। আগের মতই সেটা পড়ে আছে বৃদ্ধ ন্যুব্জ ভাব নিয়ে।  ধীরে ধীরে ড্রাইভ করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ একটা মুখ তাঁর নজরে পড়ে গেল। চেনা একটা মুখ। ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! 
অনন্যা না ! চমকে উঠলেন রমাকান্ত। থেমে গেলেন তিনি। গাড়ির দরজা খুলে ধীরে ধীরে বাইরে এসে নেমে দাঁড়ালেন। হ্যাঁ, অনন্যা,  আরও কালো হয়ে গিয়েছে, সেই উজ্জ্বলতা কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছে। শরীরে তার ময়লা শাড়ি জড়ানো, ঝুলঝুলে অমাপের একটা ব্লাউজ তার বুকে জড়ানো। তার চোখের কোলে কালো ছোপ। স্পষ্ট বুঝতে পারলেন রমাকান্ত, সে অনন্যা হিয়ে গেছে--অর্থহীনতায়, বুভুক্ষায়, দুঃখ কাতরতায়। আর এইসব লক্ষণগুলোই তো মানুষকে বোধবুদ্ধিহীন নিম্ন মাত্রায় টেনে নেয়।   
এক গ্লাস জল নিয়ে অনন্যা কখন যেন রমাকান্তর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে,  আপনাকে খুব পরিশ্রান্ত লাগছে, রমা দা ! আপনার জন্যে জল এনেছি, হাত বড়িয়ে জলের গ্লাস এগিয়ে দিল অনন্যা। 
সত্যি এ মুহূর্তে ভীষণ তৃষ্ণার্ত রমাকান্ত, এত কিছুর পরেও অনন্যা তা বুঝতে পেরেছে ? জলের গ্লাস তিনি হাতে তুলে নিলেন। অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন আছো, অনন্যা ?
অনন্যা কিছু বলল না, তার মুখে এক চিলটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। 
না, কোথাও নেই, সেই অনন্যার লক্ষণ আজের অনন্যার মধ্যে কোথাও খুঁজে পেলেন না রমাকান্ত। জলটা হাতে ধরে আছেন তিনি। 
--খুব পরিশ্রান্ত লাগছে আপনাকে, গরমে আপনার মুখটা কেমন লাল পড়ে গেছে ! অনন্যার কুণ্ঠিত গলা শুনতে পেলেন রমাকান্ত।  
এক রাশ ব্যর্থতা জমা পড়ে আছে রমাকান্তর মনে। তিনি জলের গ্লাস মুখের কাছে তুলেও নামিয়ে নিলেন। না, গ্লাসের চেহারা ভালো লাগছে না--আর তা ছাড়া জলের রঙও কেমন যেন ঘোলাটে ! পিউরিফাই জল ছাড়া তিনি তো কিছুই মুখে দিতে পারেন না—রমাকান্ত যেন আপন মনেই বলে উঠলেন, না, একদম জল তেষ্টা নেই দেখছি--
রমাকান্ত ভরা জলের গ্লাসটা ফেরত দিতে হাত বাড়ালেন। অনন্যা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। নীরবে জল ভরা গ্লাসটা সে নিজের হাতে ফিরিয়ে নিলো। 
                                                সমাপ্ত 

Wednesday 6 April 2022

আমার কথা-- ঊশ্রী মন্ডল

আমার কথা
ঊশ্রী মন্ডল


                              আমার ছোটবেলাটা কেটে গিয়েছিলো দুর্গাপুরের অলিতে গলিতে,ডেয়ারি কলোনির ফ্লাটে থাকতাম,সেই সময়টা খুব সুন্দর ছিলো l হাসি গল্পে খেলাধুলা পড়াশুনার মধ্যেই কাটছিলো অথচ ভরপুর দারিদ্র ছিলো, বাবা পরলোক গমন করার পর আমরা সকলেই অসহায় হয়ে পড়েছিলাম, অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে মা আমাদের মানুষ করে তুলেছিলেন l যখন যৌবনে উত্তীর্ণ হলাম মা বিয়ে দিয়ে দিলেন , এসেছিলাম বধূ হয়ে পানাগড়ে l  
             অনুন্নত জায়গা, শিক্ষার জন্য ভালো স্কুল কিংবা চিকিৎসার জন্য হসপিটাল ছিলো না, সবেধন নীলমনি একটা হেলথ সেন্টার ছিলো, তাতেই যা চিকিৎসা হবার হতো নয়তো দুর্গাপুরেই যেতে হতো,স্কুল কলেজেও পড়ার জন্য ঐ দুর্গাপুরেই যেতে হতো, কর্মেরও কোনো সুযোগ ছিলো না l 
       যাই হোক,স্বামীর কর্মস্থল ছিলো দিল্লিতে,তাই নয় মাসের সন্তানকে কোলে করে দিল্লিতে চলে গিয়েছিলাম l ওখানে দীর্ঘ সতেরো বছর পর পরিজনদের আগ্রহে ফিরে এলাম পানাগড়ে , বাড়ি বানালাম, সামনে একটু জমি পড়ে ছিলো তাতে সবজি ফলাতাম, পাড়ার প্রতিবেশীদের দিতাম নিজেও খেতাম মনের আনন্দে l
                 কাঁকশা থানার ঠিক পিছনে কুলু পুকুর নামে একটা পুকুর আছে, তার ঠিক পাশেই আমার ঘর l পুকুরের চারিধারে অনেকটা জায়গা বড়ো বড়ো গাছে ঘেরা,একমানুষ সমান ঝোপঝাড়ে ভর্তি l পুকুরের জল বড়োই নোংরা, ওখানেই সকলে বাসন মাজে, কাপড় কাচে, আবার এদিক ওদিক চোরা নজর হেনে মূত্রও ত্যাগ করে, অবাক কান্ড ঐ জলেই স্নান করে মুখ ধোয়, মাগো কি ঘেন্না l আমি অবশ্য কোনোদিন ঐ পুকুরে যাইনি, কেননা ঘরেই আমার সব বন্দোবস্ত ছিলো l
             পঞ্চায়েত থেকে ঘরে ঘরে মলমূত্র ত্যাগের জন্য ঘর বানিয়ে দিয়েছিলো l তবুও কেন জানি না, ঐ স্থানে না গিয়ে পুকুরের পাশে ঝোপঝাড়ে পায়খানা করতে আসতো সারা পাড়া জুড়ে l কি গন্ধ, তেমনি মশা মাছি -দিনেদিনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগলাম l মাঝে মাঝে তক্কাতক্কি লেগে যেতো l আজব চিন্তাধারা ছিলো ওদের, বন্ধ ঘরে নাকি বাহ্য হয়না, তাছাড়া ট্যাংকি ভরে গেলে কে পরিষ্কার করবে ?  
      সেদিন পাশের বাড়ির দিদিটা স্বামীর অত্যাচারে গায়ে আগুন লাগিয়ে মরে গেলো l স্বামী ছিলো  পাঁড়মাতাল, রোজগারপাতি কিছুই করতো না, পেটে দেবার নয়,পিঠে দেবার গোসাঁই ছিলো l তবে,হ্যাঁ একটা গুন ছিলো, ভালো চুরি করতে পারতো, দিনের বেলায় ছিলো ভদ্রবেশী ভালো লোক, রাত্রি হলেই বেরিয়ে পড়তো নিজকর্মে l ভরপেট মদ খেয়ে বৌটারে মুখবেঁধে পিটাতো, রাগে দুঃখে মরে যেন শান্তি পেলো,ওদের বাড়ির দিকে তাকালে গাটা ছমছম করতো l আশ্চর্য কয়েকটা দিন যেতে না যেতেই ঐ বদমাশ আবার বিয়ে করে বসলো, সত্যি বাংলাদেশে পাত্রের আকাল পড়েছে, তাই ঠিকমতো খোঁজখবর না নিয়েই মেয়েদের পাত্রস্থ করছে l সৎমা কি পরের বাচ্চাকে ভালো বাসতে পারে, তাই কচি কচি বাচ্চাগুলো খেতে পেতো না,বেশিভাগ দিনই শুকনো মুখে খাবারের আশায় বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতো,দেখে বড়ো মায়া লাগতো,মাঝে মাঝে সাহায্য করতাম l আমরাও দিন আনি দিন খাইয়ের দলেরই লোক, তাই বিশেষ একটা সাহায্য করতে পারতাম না l একসময় ওরা দক্ষচোর হয়ে গেলো এবং ধনীও হয়ে উঠলো l যাক গে, ওদের কথা ভেবে আমার কি লাভ ,তাই নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে লাগলাম, সে কলেজে পড়ে পল.সাইন্স এ অনার্স নিয়ে রানীগঞ্জে, আসতে আসতে রাত্রি হয়ে যায়, যতক্ষণ না ঘরে ঢোকে ততক্ষন বেশ চিন্তায় থাকি l
           কার্যোপলক্ষে আমার স্বামী আবার চলে গিয়েছেন গোয়ায় l সেদিন স্বামী বলছিলেন উনি নাকি লিফটে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন, দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, কি করে বেরোতে পারবে ভেবেই পাচ্ছিলো না l নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে ফোনও করতে পারছিলো না l ভাগ্যিস ওখানকার লোকেদের হঠাৎ মনে পড়ে রবীন মন্ডল নিখোঁজ ,তাই খোঁজ করতে থাকার পর বন্ধ লিফটের হদিস পায়, তারপর অনেক  কষ্টে গেট কেটে বের করে আনে, একথা শুনে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম l
       
           আমি তখন চাকরি করতাম একটা পেট্রল পাম্পে, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসাবে l সেদিন দিদি বললো, মায়ের শরীরটা ভালো নেই, তোকে দেখতে চাইছে, একবার ঘুরে যাস l বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিলাম আমার আজকে ঘরে ঢুকতে একটু দেরী হয়ে যাবে, চিন্তা যেন না করে, দরকার পড়লে দিদির বাসাতেই থেকে যাবো, একটু সামলে নিয়ো l
         মায়ের কাছে গিয়ে দেখি,মা শুয়ে আছে ক্লান্ত শ্রান্ত রোগজীর্ণ মুখ, কিন্তু ভালো আছেন আগের তুলনায়, কিছুক্ষন বসে গল্প করলাম l এবার ছেলে ও স্বামীর জন্য মন খারাপ করতে লাগলো l ভাবছি, কাল সকালে ছেলে কলেজে যাবে, ওনারও ডিউটি সকালেই, সব সামলে নিতে পারবে তো ? বেরিয়ে পরি, এখন বেরিয়ে পড়লে পানাগড় যাবার লাস্ট বাসটা পেয়ে যাবো, যেই না ভাবা অমনি উঠে পড়লাম , মা বললেন, থাক না আজকে এইখানে কালকে এখান থেকেই ডিউটিতে চলে যাস l আমি নানান অজুহাত দেখিয়ে মাকে মানিয়ে হন্টন দিলাম মুচিপাড়ার উদ্দেশ্যে l এসে শুনি লাস্ট বাস চলে গেছে,মায়ের কাছে ফিরে যাবো নাকি, ভাবতে ভাবতে দেখি স্টেশনে যাবার একটা বাস আসছে l ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারলে  ব্ল্যাক ডায়মন্ডটা পেয়ে যাবো, বাসে উঠে পড়লাম l স্টেশনের প্লাটফর্মে এসে শুনি ট্রেন লেটে চলছে, অগত্যা অপেক্ষা করতে লাগলাম, অবশেষে ট্রেন এলো, চড়ে বসলাম এবং পানাগড়ে এসে নামলাম l গ্রামাঞ্চল তো একটু রাত হলেই নিঝুম হয়ে যায় l 
       হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে আমাদের পাড়ায় এসে পৌছালাম, একটু শর্টকাট নিলাম, কুলু পুকুরের পাশ দিয়ে যে সরু রাস্তাটা গিয়েছে তা ধরলাম l একটু এগিয়ে দেখি এক মহিলা পুকুর থেকে উঠে আসছে, বলে, কে যাও গো..গুড্ডুর মা নাকি ? আমি বললাম,' হ্যা ' , সেও আমার সাথে হাঁটতে লাগলো, সে নানান কথা বলতে লাগলো, বলল, ' তালের বড়া করবে তো? আমি আজকেই হাট থেকে তাল কিনেছি, তুমি কেননি ? 'আমি বললাম, 'সারাদিনের পরে এই ঘরে ঢুকছি, কোথায় তাল পাবো পরের হাটে কিনে নেবো |' হটাৎ খেয়াল করি , ফকিরের মা যেন লম্বায় আমার থেকে একটু বেশী বেড়ে গেছে , অথচ ওতো অনেক ছোটোখাটো মানুষ ! ভাবতে ভাবতে চলছি, আবার পাশে তাকিয়ে দেখি ওমা ও যে একটু একটু করে লম্বা হয়ে যাচ্ছে, তাল গাছতার পাশে যেই দাঁড়ালাম অমনি সে হাত বাড়িয়ে দুটো তাল পেড়ে আমায় দিলো, আমার তো ভয়ে হাত পা ঠক ঠক করে কাঁপছে, বলে উঠলাম, ' হে রাম, তুমি এটা কি করে করলে  ? ' যেই না বললাম, অমনি সে বলে উঠলো,   ' দূর ছাই, এই শত্তুরটার নাম নিতে কে বললো ? জানো না,হাট থেকে ফিরেই আমি হার্টফেল করে মরে গেছি, তারপরই তো ভূত হয়ে গেছি l ভাবছিলাম এবার তোমার ঘাড় মটকাবো, তা হতে দিলে না, এখন এবারের মতো গেলাম,পরের বার যদি মওকা পাই অবশ্যই ঘাড় ভাঙবো তোমার l' আমি ভয়ের চোটে ও বাবা, ও মা বাঁচাও গো বলে চিৎকার করে ছুট লাগালাম, একবার হোঁচট খেয়ে পড়ি,আবার উঠে ছুট লাগাই, পিছন থেকে শুনতে পাচ্ছি হি হি হি হি হাসির শব্দ l কোনোরকমে প্রাণ হাতে নিয়ে ঘরে এলাম,সেদিন থেকে আর ঐ পুকুরের রাস্তায় যাইনি l
                পেট্রল পাম্পের মালিকানা বদল হওয়াতে আমার চাকরি গেলো, অনেক চেষ্টা করেছিলাম, বয়েসের অজুহাতে সুযোগ পেলাম না, সকলেরই  
ড্যাশিডুশি মেয়ে চাই l এখন আমি আর আমার ছেলেই থাকি, ছেলে কলেজে বেরিয়ে গেলে ভীষণ একা লাগে , মাঝে মাঝে অবশ্য দুর্গাপুরে মায়ের সাথে দেখা করতে যাই l কিছুই করার নেই তাই নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো লিপিবদ্ধ করি, এই ভাবেই সময় কেটে যায় l

সেই প্লাবনে-- সাবিত্রী দাস

সেই প্লাবনে
সাবিত্রী দাস 

সমুদ্র নিয়ে  অমিতার মনে বেশ একটা  রোম্যাণ্টিক ভাবনাই ছিল বলতে গেলে । আসলে ঐ ভাবনাটা এসেছিল   দুবছর আগে ছাব্বিশে জানুয়ারি রজতের সঙ্গে পুরী গেছিল, সেই তখন থেকেই। সমুদ্র সৈকতে ঝিনুক কুড়িয়ে বেড়িয়েছে কোনদিন , কখনো আবার পায়ের পাতা জলে ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে।পায়ের তলা দিয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতিতে হয়েছে রোমাঞ্চিত। পায়ের তলার বালি গুলো সুড়সুড় করে সরে সরে যাচ্ছিল আর ততই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল। দেখেছিল মাছ ধরা ডিঙিগুলো কেমন ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে এগিয়ে আসে । সেই তখন থেকেই অমিতা  স্বপ্ন দেখত  সমুদ্রের  ঢেউয়ের তালে তালে  দুলতে দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে ।

                তাই বলে সেই  স্বপ্ন যে তার এমন করে সত্যি হবে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারে নি অমিতা।

ভয়ঙ্কর এই ঘূর্ণাবর্ত কোথায় নিয়ে আছড়ে ফেলবে তাকে, আতঙ্কে দিশাহারা অমিতা ভাবতেই পারছে না, আসলে ভাববার মতো মনের অবস্থা তার আর নেই।

     রজতের সঙ্গেই এসেছিল দীঘায়,সেটাও অমিতার ইচ্ছেতেই। রজত স্ত্রীকে  ভালোই চেনে। বাধা দিয়ে লাভ নেই জানে তাই ব্যাগ গুছিয়ে সঙ্গী হয়েছিল।
সতর্ক বার্তাও শুনেছিল হোটেলের ঘরে বসেই । তবুও রোমাঞ্চকর অভিযানের খোঁজে সকলের চোখ এড়িয়ে দুজনেই বেরিয়ে এসেছিল পায়ে পায়ে।
ঘুরপথে এসে দাঁড়িয়ে দূর থেকেই দেখছিল সমুদ্রের বিশাল বড়ো বড়ো ঢেউগুলো  সবেগে আছড়ে পড়ছে। ছাতা আড়াল করে  কয়েকটা ছবি তুলছিল, কী যে হলো হঠাৎ করে একটা বিশাল বড়ো ঢেউকে এগিয়ে আসতে দেখল, তারপরেই সব অন্ধকার! অমিতা এখন জলের তলায়, একবার ডুবছে একবার ভেসে উঠছে । হাতটা তুলতে চেষ্টা করলো ভীষন ভারী! একটা কোনোকিছুর সঙ্গে আটকে আছে। ভাসতে ভাসতে কতদূর চলে এসেছে বুঝতে পারছে না। এখানে জলোচ্ছ্বাস ততটা প্রবল নয়।একটু থিতু হতেই মনে হলো রজতের কথা ।সে কোথায়!
দেখলো তার হাত আটকে গেছে একটা বড়ো গাছের গুঁড়ির সঙ্গে,শুধু হাত নয় তার পুরো শরীরটাই এখন গাছের ডালপালা গুলোর সঙ্গে একসাথে ভাসছে। গাছের সঙ্গে  না আটকে থাকলে সে এতক্ষণে জলের তলায় পৌঁছে যেত। রজতের খোঁজে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে। 
এতক্ষণে নজর পড়ে ঐ গাছেরই একটা মোটা ডাল আঁকড়ে ধরে ভাসছে রজত।
এভাবেই ভেসে যাচ্ছে দুজনে। কতক্ষণ কে জানে!বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে সমানে, অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। অমিতার পাশদিয়ে সম্ভবতঃ একটা সাপ পেরিয়ে গেল। সমস্ত  শরীর ভয়ে শিরশির করতে থাকে। কোন কিছুর পচা দুর্গন্ধে গা ঘুলিয়ে উঠছে। বমি পাচ্ছে,ভীষণ বমি পাচ্ছে  অমিতার। 
 তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে , বড়ো অবসন্ন লাগছে, শরীর সায় দিচ্ছে না। এ জল তো এত নোংরা বলার নেই। রজতও বুঝতে পারছে অমিতা আর পারছে না। কী করবে সে!
যে করেই হোক  অমিতার কাছে  ওকে পৌঁছতেই হবে! 
এক হাতে ডালটা ধরে হাত বাড়িয়ে অন্য ডাল ধরে আস্তে আস্তে পা ঘষে ঘষে  ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। 
অমিতার কাছে গিয়ে ওর হাতের উপর হাতটা রাখতেই চমকে ওঠে রজত। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে যে! অমিতার মুখে কেমন একটা ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠে পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়।  কী করবে ভাবতে পারে না রজত, এই প্রথমবার নিজেকে ওর বড্ড অসহায় বলে মনে হয়। অমিতার শরীরটা কেমন যেন শিথিল হয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে না! না না এ তার মনের ভুল, সেরকম কিছু হতেই পারে না অমিতার !
অমিতাকে অচৈতন্য দেখে ভয়ে আতঙ্কে একেবারে দিশাহারা  হয়ে যায়, সব শেষ  হতে বসেছে। যেটুকু আশা ছিল.......
  অমিতার জ্ঞান ফেরাবে কী করে!
  ভুলে যায় নিজের অবস্থান, দু হাতে ধরে ঝাঁকুনি দিতে যায় আর হাত ফসকে একবারে  অথৈ জলে। মুহুর্তের মধ্যে প্রবল জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল।
অচৈতন্য অমিতা এসব কিছুই জানতে পারলো না! গাছের সাথে আটকে জলপ্লাবনে ভেসে চললো সেও,একা! একেবারে একা!

নারী বাদ--জয়িতা ভট্টাচার্য

নারী  বাদ--
জয়িতা ভট্টাচার্য 

ফুলরেনু দেবী আজ ভীষণ ব্যস্ত।সকালে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ উল্টেই চানঘরে।আয়নায় আপাদমস্তক দেখে হাসি খেলে যায় ঠোঁটে। তারিফ করেন নিজের দেহ সুষমা দেখে নিজেকেই।
এইজন্য রাহুল হবার পর বুকের দুধ দেননি।
সে এখন প্রবাসী।
শরীরের খাঁজে বিদেশী পারফিউম আর জামদানি শাড়ি,হাল্কা গয়না।মালতি খাবার নিয়ে আসে।টিংটিঙে রোগা,কালো,ফুলছাপ শাড়িতে রিফু।আজ তিনি খুব ব্যস্ত।বঙ্গ সমাজে ফুলরেণু নারীবাদী লেখিকা হিসেবে বিখ্যাত। নারী দিবসের অনেকগুলি অনুষ্ঠানে  আজ বক্তব্য রাখবেন।ক্লাবে যাবেন। সাদা বি-এম-ডব্লিউ মসৃণ গতিতে চলেছে। 
তিনি কখনও চাকরি করেননি।দরকার হয়নি।স্বামী বড়ো আমলা ছিলেন।সুশোভন আর তিনি একটা বাড়িতেই থাকেন দুটি ভিন্ন গ্রহের মতো বহু বছর।ফুলরেনু অন্যমনস্ক হয়ে যান।অনেক এঘর ওঘর হয়েছে শুধু সুশোভনই কেমন অচেনা রয়ে গেলো।  রাতে ফিরে দেখতে পেলেন সুশোভন বসার ঘরে,টিভি দেখছে,হাতে দামি হুইস্কি।
মাঝরাতে মালতির বেড়ার ঘর থেকে চিৎকারে তাঁর ঘুম ভেঙে গেলো।কাঁদছে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে মেয়েটা। বরটা বেকার,মাতাল।রাগে গনগনে ফুলরেনু  ছুটে যান মালতির ঘরে।মালতীকে আড়াল করে বকাবকি করতে থাকেন।তিরস্কার করেন লোকটিকে নিজস্ব তেজে।পুলিশকে খবর দিতে উদ্যত হন।মালতির গায়ে কালশিটে।
মাতাল ছোটু  একটু দমে যায়।পুলিশের কথা শুনে।কিন্তু, 
এতক্ষণ মালতি একটু থমকে ছিলো।পুলিশের কথায় হঠাৎ  সামনে এসে পড়ে। 
-'ইশ পুলিশে দিবে কী জন্যি আমি থাকতে অরে পুলিশে দিবে! সারা শরীরে মারের দাগ নিয়ে  মালতি জাপটে ধরে ছটুকে।
" আমার বর আমাকে মারবে বেশ করবে কার কী "।
ছোটু এখন জড়িয়ে আছে মালতীকে।বন্ধ দর্মার দরজার সামনে ফুলরেনু  কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন।ধীরে ধীরে ঘরে ঢোকেন মাথা নিচু করে।
কী যেন নেই তার কাছে যা ওই মূর্খ মালতির ঘরে আছে।
                  🎭

পরিবার আর স্কুল শিক্ষার ফল-- রূপো বর্মন

পরিবার আর স্কুল শিক্ষার ফল  রূপো বর্মন  একদিন সকাল দশটা নাগাদ। বছর এগারোর একটি মেয়ে ও একটি ছেলে বেশ আনন্দে হাটতে হাটতে স্কুলে যা...